আমরা স্বরচিহ্ন বা কার নিয়ে আলোচনা করেছি ৩য় পর্বে। এবার ব্যঞ্জনবর্ণের চিহ্ন অর্থাৎ ফলা নিয়ে আলোচনা করব এই ৪র্থ পর্বে। ন-ফলা (ন/ণ), ম-ফলা, য-ফলা, র-ফলা/রেফ, ল-ফলা, ব-ফলা এই ছয়টি ফলা রয়েছে বাংলায়।
ন-ফলা ন বা ণ দু'টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ন নিয়েই একটু আলোচনা করা যায়। ন-ফলা তার পূর্ববর্তী বর্ণের নিচে ছোট আকারে ব্যবহৃত হয়। শুধু হ-এর সঙ্গে একটু অন্য রূপে ব্যবহৃত হয়।
গ্+ ন= গ্ন অগ্নি, ভগ্ন ইত্যাদি
ঘ্ + ন = ঘ্ন বিঘ্ন, কৃতঘ্ন ইত্যাদি
ত্ + ন = ত্ন রত্ন, যত্ন ইত্যাদি
ধ্ +ন = ধ্ন গৃধ্নু ইত্যাদি
ন্ + ন = ন্ন ছিন্ন, ভিন্ন ইত্যাদি
প্ + ন = প্ন স্বপ্ন,
ম্ + ন = ম্ন নিম্ন
শ্ + ন = শ্ন প্রশ্ন
স্ + ন = স্ন স্নান
হ্ + ন = হ্ন আহ্নিক, বহ্নি ইত্যাদি
ণ-ফলা
ণ + ণ = ণ্ণ, বিষণ্ণ
ষ + ণ = ষ্ণ, বিষ্ণু
হ্ + ণ = হ্ণ, অপরাহ্ণ
ম-ফলা
ক্ + ম = ক্ম, রুক্মিণী
গ্ + ম = গ্ম, যুগ্ম
ঙ্ + ম = ঙ্ম বাঙ্ময়
ত্ + ম = ত্ম, আত্মা
দ্ + ম = দ্ম, পদ্ম
ন্ + ম = ন্ম, জন্ম
ম + ম = ম্ম, সম্মান
ল্ +ম = ল্ম, গুল্ম
শ +ম = শ্ম, রশ্মি
ষ্ + ম = ষ্ম, গ্রীষ্ম
স্ + ম = স্ম, ভস্ম
হ্ + ম =হ্ম, ব্রহ্ম
ম-ফলায় ম-এর উচ্চারণ উহ্য থাকে এবং পূর্ববর্তী ধ্বনির দ্বিত্ব ঘটে, যেমন পদ্ম = পদ্দ। শুধু গ্ম, ন্ম ও ল্ম -এর ক্ষেত্রে ম-এর উচ্চারণ বজায় থাকে। এছাড়া হ্ম-এর ক্ষেত্রে ম ধ্বনির দ্বিত্ব ঘটে, যেমন ব্রহ্ম = ব্রম্ম।
য-ফলা
য-ফলা তার পূর্ববর্তী ধ্বনির ডানপাশে বসে। আসলে য-এর উচারণ Y-এর মতো হওয়ার কথা, কিন্তু বাংলায় তা হয় না, য-ফলায় এই উচ্চারণ থেকে গেছে। বিভিন্ন ধ্বনির সঙ্গে য-ফলার ব্যবহার ও শব্দে তার প্রয়োগ দেখানো হল :
ক্ + য = ক্য বাক্য
খ্ + য = খ্য ব্যাখ্যা, খ্যাতি
গ্ + য = গ্য ভাগ্য
চ্ + য = চ্য বাচ্য
ছ্ + য = ছ্য ছ্যাবলা
জ্ +য = জ্য রাজ্য
ট্ + য = ট্য অকাট্য
ঠ্ + য = ঠ্য পাঠ্য
ড্ + য = ড্য জাড্য
ঢ্ + য = ঢ্য ধনাঢ্য, ঢ্যামনা
ণ্ + য = ণ্য অরণ্য
ত্ +য = ত্য সত্য, ত্যক্ত
থ্ + য = থ্য মিথ্যা
দ্ +য = দ্য সদ্য
ধ্ + য = ধ্য মধ্য, ধ্যান
ন্ + য = ন্য অন্য, ন্যায়
প্ + য = প্য আপ্যায়ন
ফ্ + য = ফ্য ফ্যালফ্যাল
ব্ + য = ব্য
ব্যাধ, নব্য
ভ্ + য = ভ্য সভ্য
ম্ + য = ম্য কাম্য
য্ + য = য্য ন্যায্য
র্ + য = র্য র্যাম্প
ল্ + য = ল্য বাল্য
শ্ + য = শ্য শ্যাম, বৈশ্য
ষ্ + য = ষ্য শিষ্য
স্ + য = স্য শস্য
হ্ + য = হ্য সহ্য
উপরের উদাহরণ থেকে কিছু জিনিস লক্ষ যায়। য-ফলায় Y উচ্চারণ নেই বললেই চলে। বরং পূর্ববর্তী ধ্বনির দ্বিত্ব ঘটে। যেমন, নব্য=নব্য় হয় না, বরং নব্ব হয়ে যায়। এটা ঘটে পদের মধ্যে বা অন্তে। পদের প্রথমে Y বা য় উচ্চারণ থেকে যায়, যেমন, ধ্যান = ধেয়ান হয়। এটা বাংলায় ব্যবহৃত অ্যা স্বরধ্বনির (বর্ণমালায় নেই) প্রভাবে বা পদের শুরুতে ধ্বনির দ্বিত্ব সম্ভব নয় বলেই হয়েছে। হ্য-এর ক্ষেত্রে য-এর ধ্বনিদ্বিত্ব হয়, হ-এর হয় না। যেমন, সহ্য = সয্য (সহ্হ নয়)।
র-ফলা/রেফ
র্ ব্যঞ্জন বর্ণের আগে ধ্বনি হিসেবে ব্যবহৃত হলে রেফ হয়ে যায়। ব্যঞ্জনধ্বনির পরে বর্ণ হিসেবে ব্যবহৃত হলে র-ফলা হয়।
রেফ-এর ব্যবহার
র্ + ক = র্ক অর্ক
র্ + খ = র্খ গোর্খা
র্ + গ = র্গ বর্গ
র্ + ঘ = র্ঘ দীর্ঘ
র্ + চ = র্চ অর্চনা
র্ + ছ = র্ছ মূর্ছা
র্ + জ = র্জ অর্জন
র্ + ঝ = র্ঝ নির্ঝর
র্ + ট = র্ট আর্ট
র্ + ড = র্ড কার্ড
র্ + ণ = র্ণ
বর্ণ
র্ + ত = র্ত শর্ত
র্ + থ = র্থ তীর্থ
র্ + দ = র্দ পর্দা
র্ + ধ = র্ধ অর্ধ
র্ + প = র্প সর্প
র্ + ব = র্ব গর্ব
র্ + ভ = র্ভ দুর্ভাগ্য
র্ + ম = র্ম মর্ম
র্ + য = র্য আর্য
র্ + ল = র্ল দুর্লভ
র্ + শ = র্শ বর্শা
র্ + ষ = র্ষ হর্ষ
র্ + স = র্স ফর্সা
র্ + হ = র্হ গর্হিত
র-ফলা
ক্ + র = ক্র বক্র
খ্ + র = খ্র খ্রিস্টান
গ্ + র = গ্র গ্রহ
ঘ্ + র = ঘ্র ঘ্রাণ
জ্ + র = জ্র বজ্র
ট্ + র = ট্র ট্রেন
ড্ + র = ড্র ড্রাম
ত্ + র = ত্র ত্রাস
থ্ + র = থ্র থ্রি
দ্ + র = দ্র দরিদ্র
ধ্ + র = ধ্র ধ্রুপদী
প্ + র = প্র প্রমাণ
ফ্ + র = ফ্র আফ্রিকা
ব্ + র = ব্র ব্রত
ভ্ + র = ভ্র ভ্রমণ
ম্ + র = ম্র নম্র
শ্ + র = শ্র বিশ্রাম
হ্ + র = হ্র হ্রদ
রেফ মানে হসন্ত র, এর পরে স্বরধ্বনি থাকে না। 'কয়ে রেফ' বলা হয় যদিও র-ধ্বনি কিন্তু ক-এর আগে উচ্চারিত হয়, আর র-ফলায় র পরে উচ্চারিত হয়। হ্র-এর ক্ষেত্রে ধ্বনি বিপর্যয় ঘটে, অর্থাৎ র আগে এসে যায়। উচ্চারণটা হ্রদ না হয়ে র্হদ হয়ে যায়।
ল-ফলা
পূর্ববর্তী বর্ণের নিচে ল ছোট আকারে ব্যবহৃত হয়ে ল-ফলা হয়। যেমন,
ক্ + ল = ক্ল ক্লেশ
গ্ + ল = গ্ল গ্লানি
প্ + ল = প্ল প্লাবন
ফ্ + ল = ফ্ল ফ্ল্যাশ
ব্ + ল = ব্ল
ব্লাউজ
ম্ + ল = ম্ল ম্লান
ল্ + ল = ল্ল মল্ল
শ্ + ল = শ্ল
শ্লীলতা
স্ + ল = স্ল স্লোগান
হ্ + ল = হ্ল আহ্লাদ
ব-ফলা
বাংলা বর্ণমালায় দু'টি ব আছে। ব-ফলায় অন্তঃস্থ ব ব্যবহার হয়, যার উচ্চারণ w-এর মতো। হিন্দি, অসমিয়া ইত্যাদি ভাষায় আলাদা বর্ণ আছে, যেমন व, ৱ। ব-ফলা পূর্ববর্তী বর্ণের নিচে বসে। যেমন,
ক্ + ব = ক্ব পক্ব
গ্ + ব = গ্ব দিগ্বিজয়
জ্ + ব = জ্ব জ্বর
ত্ + ব = ত্ব
দাসত্ব
থ + ব = থ্ব
পৃথ্বী
দ্ + ব = দ্ব
বিদ্বান
ধ্ + ব = ধ্ব
ধ্বনি
ন্ + ব = ন্ব
অন্বয়
ম্ + ব = ম্ব
ডিম্ব
ল্ + ব = ল্ব
বিল্ব
শ্ + ব = শ্ব
অশ্ব
ষ্ + ব = ষ্ব
পিতৃষ্বসা
স্ + ব = স্ব
স্বাদ
হ্ + ব = হ্ব আহ্বান
ব-ফলার ব যেহেতু অন্তঃস্থ ব, তাই এর 'ওয়া' উচ্চারণ বিলুপ্ত হয়ে পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনধ্বনির দ্বিত্ব ঘটে। যেমন, পক্ব = পক্ক (পক্ও নয়)। কিন্তু গ্ব ও ম্ব-এর ক্ষেত্রে ঔষ্ঠ্য ব উচ্চারণ হয়; যেমন, ডিম্ব = ডিম্ব। হ্ব-র ক্ষেত্রে অন্তঃস্থ ব দ্বিত্ব ঘটে প্রথমটি উচ্চারিত হয় ও-এর মতো; যেমন, আহ্বান = আওবান।
ফলা নিয়ে আলোচনা আপাতত এই পর্যন্তই যথেষ্ট। পরবর্তী পর্বে আমরা আলোচনা করব যুক্তবর্ণ বা যুক্তব্যঞ্জন নিয়ে, ফলা যার একটা অংশবিশেষ।
x
No comments:
Post a Comment